Bangla StoriesStory

মৃত্যর পর তো এই কালো রঙেই সবাইকে ফিরতে হবে Heart touching Bangla Story

“চাঁপী”
২ ঘন্টা যাবত আমার নগ্ন লাশটা পোস্ট মর্টেমের জন্য পরে আছে।
পুলিশ ইন্সপেক্টর অমল ঘোষ আমার লাশটার দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই হেসে বলে উঠলেন এই বয়সেও বিয়ের শখ যায়নি।
এরপরই ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করুন তো।
এরপর লাশ আবার পরিবারকে ফেরত দিতে হবে।
যত্তোসব ঝামেলা।
বলেই আমার কালো বেঢপ শরীরের দিকে আবার তাকালেন।
বিয়ের জন্য পরা চন্দনের দাগ মুখে এখনো রয়ে গেছে।

আমি চাঁপা চক্রবর্তী।
ডাক নাম চাঁপী।
জন্মের সময় কালো গায়ের রং দেখে বাবা এই নাম রেখেছিলেন।
বাবা আমার মুখ দেখেই নাকি বলেছিলেন “দেখো, এই মেয়েই আমাদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে।”

ভগবান বোধ করি বাবার দিকে চেয়ে ব্যাঙ্গ হাসিটা সেদিনই হেসেছিলেন।
ছোটোবেলা থেকেই দাদা বৌদি আর পড়শিদের খোটা শুনেই বড় হয়েছি।
হেসেলে ঢুকলে বৌদিরা পাতিলের তলার সাথে আমার তুলনা করতে পারলেই যেন সার্থক হতেন।
একদিন বড় বৌদি আমার গালে কালি দিয়ে বলছিলেন আরে ও ঠাকুরঝি তোমার মুখের কোথায় যে কালি লাগিয়েছি তাতো ঠাওরই করতে পারছিনে গো।
এ নিয়ে বাড়ির সবার কি হাসাহাসি!
আমিও সবার সাথে হেসেছিলাম।
ওসব কথা এখন আর অমার গায়ে লাগে না।
তবে মায়ের বোধ হয় সহ্য হলো না।
সারা রাত মুখে আঁচল গুজে কেঁদেছিলেন।

জীবনে প্রথম ভালোবাসা ছিলো রবিদা। ছোটো থাকতে পাশের বাড়ির সুধা কাকীমার বাড়ি প্রায়ই দৌড়ে চলে যেতাম আর রবিদার কাছে রাজ্যের গল্প শুনতাম। প্রায়ই পাঠশালা ফাঁকি দিয়ে তার বই পড়তাম। একদিন রবিদা আমার হাত ধরে বলেছিলেন “হ্যা রে চাঁপী বড় হয়ে আমায় বিয়ে করবি?” সেদিন লজ্জায় কিছু বলতে পারি নি মুখ ফুটে। ঘরে ছুটে এসেছিলাম। এরপর থেকে রবিদার সামনে যেতে ভারি লজ্জা পেতাম। তখন থেকে সেই ছিলো আমার কল্পনার রাজকুমার। বড় হতে থাকি আর কল্পনার রাজ্য বিস্তৃত হতে থাকে। কল্পনার সবটাই ছিলো রবিদাকে ঘিরে। ভাবতাম রবিদার কল্পনাও বুঝি আমায় নিয়ে। কিন্তু সে কল্পনা বেশিদিন টিকলো না যখন জেনেছিলাম আমার সই সুহেলির সাথে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছুটে গিয়ে রবিদাকে সুধিয়েছিলাম তবে বললে কেন আমায় বিয়ে করবে? রবিদা ঘর ফাটানো হাসি হেসে বললেন সে তো মজা করেছিলাম। তোর মত কালিকে কে বিয়ে করবে রে? আমিও রবিদার সাথে হেসেছিলাম, তাকে যে সত্যিই ভালোবেসেছিলাম সেই লজ্জা ঢাকতে। ফিরে আসার সময় নির্লজ্জের মত হাসতে হাসতে বলেছিলাম রবিদা তোমার বিয়েতে কিন্তু আমায় একখানা লাল পেড়ে শাড়ি দিতে হবে বলে রাখলাম। রবিদা সেই কথাখানা রেখেছিলো। শাড়িখানা পরে নিজেকে আয়নায় অনেকবার দেখেছিলাম। সত্যিই রবিদার পাশে আমি বড্ড বেমানান। কি রাজপুত্রোর মত চেহারা ওর। খুব কেঁদেছিলাম সেদিন। ভগবানের উপরও বড্ড রাগ হচ্ছিলো। আমার দাদা দিদিরা তো কত্ত সুন্দর আর আমায় গড়ার সময়ই বুঝি ভগবানের সাদা রঙের কমতি পরলো!

বাবা আমার বিয়েরও তোর জোর শুরু করলেন। ১৫ তে পা দিয়েছি।। এখন বিয়ে না দিলেই নয়। কিন্তু একখানাও বাবার পছন্দমত প্রস্তাব আসে না আমি কালো বলে। কোনো ছেলের দুই বউ, কারো বয়স বাবার চেয়েও বেশী, কারো আবার পণ বেশি চায়। বৌদিরা বলাবলি করে ঠাকুর মশাই ঠাকুর ঝির জন্য কোন রাজপুত্তুরের আশায় বসে আছে গো? যে গায়ের রং এর ছিরি! আস্তে আস্তে আমার বয়স বাড়তে থাকে। বয়স ২৫ এ এসে ঠেকেছে। ছেলেপক্ষের সামনে নিজেকে হাজির করতে করতে আমি বড় ক্লান্ত। কোনো শুভ অনুষ্ঠানে আমার যেতে বারণ। পাছে তাদের কোনো অমঙ্গল হয়। আমি যে অপয়া, অলক্ষী। ২৫ এ এসেও একখানা বর জুটোতে পারলাম না।

সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম যেদিন বড়দিদি ওর মেজো মেয়ের বিয়েতে আমায় ছাড়া সবাইকে নেমন্তন করেছিলো। আমি একখানা শাড়ি ঠিক করে রেখেছিলাম ওর বিয়েতে পরবো বলে। কিন্তু বিয়ের দিন শুনি আমার নেমন্তন্ন নেই। একথা শুনে মাও আর যায়নি। সারারাত মায়ের বুকে মুখ গুজে কেঁদেছিলাম। মায়েরও ভারি কষ্ট হয়েছিলো সেদিন।

আজ আমার বিয়ে। ৩৭ এ এসে অবশেষে একখানা বর জুটোতে পারলাম। বরের বয়স নাকি ৬৫’র ঘরে। তবে এ নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নেই। পুরুষের আবার বয়স কি গো? তাছাড়া শুনেছি সে নাকি ভারি সুপাত্র। যদিও তাদের দাবী একটু বেশী। ১০ ভরি সোনা আর নগদ ৫,০০০ টাকা। কি জানি দাদারা জোগাড় করতে পারলো কিনা! মা যদিও রাজি ছিলেন না কিন্তু বাবা স্বর্গে যাওয়ার পর মাযের কথার কোনো মূল্য নেই এখন আর এ বাড়িতে। দাদা বৌদিরাই সব।

আমায় সাজানো শেষ। লাল বেনারসী অার চন্দন। কালো চামড়ার ওপর সাদা চন্দনটা ভারি চোখে পরছে। ঠোঁটের লাল রং টাও কেমন বেমানান ঠেকছে। ও নিয়ে আমার কোনো চিন্তা নেই। শেষ পর্যন্ত বিয়েটা তো হচ্ছে। এখন আর আমায় কেউ অপয়া অলক্ষী বলবে না। কারো খোটা শুনতে হবে না আর। বর চলে এসেছে। সবাই খুব হইচই করছে। কেউ কেউ আবার বুড়ো বর বলে খোটাও দিচ্ছে। আমি ওসব গায়ে মাখছি না। একটু পরই লগ্ন শুরু হবে। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।

বিয়েটা আর হল না শেষ পর্যন্ত। পণের টাকা গয়না কিছুই জোগাড় হয়নি। দাদারা ভেবেছিলেন কোনো ভাবে বিয়েটা চুকে গেলেই হয়ে যাবে। কিন্তু বরপক্ষ বেজায় চালাক। পণের টাকা না নিয়ে বিয়ে শুরু করবে না। মা তাদের পায়ও ধরেছিলেন। লাভ হয়নি কোনো। বিয়ে ভেঙে দিয়ে সবাই চলে গেল। আমি একা ঘরে মূর্তির মত বসেছিলাম। কাঁদার শক্তিটুকুও ছিলো না আর।

রাত হয়েছে অনেক। সবাই ঘুমুচ্ছে। মা বোধহয় পাশের ঘরে বসে এখনও কাঁদছে। বড় বৌদি বলে দিয়েছে মাকে কাল সকালেই আমায় নিয়ে কাশী চলে যেতে। আমায় অার ঘরে তারা রাখবে না। কিন্তু আমার বৃদ্ধ মা এই বয়সে আমায় নিয়ে কোথায় যাবেন। অতকিছু আর না ভেবে বিয়ের শাড়িখানা দিয়েই গলায় ফাঁস দিলাম। যে শাড়িখানা পড়ে আমার শ্বশুড় বাড়ি যাবার কথা ছিলো সেটাই এখন আমার ফাঁসের দড়ি। সারারাত লাশখানা ঝুলেছে আমার। কেউ টের পেল না।

আমার লাশটা অনেক আগেই পোড়ানো শেষ। ছাইগুলো ছড়িয়ে আছে। কালো ছাই। আমার রঙের সাথে খুব মিল আছে। আচ্ছা ফর্সা আর কালো মানুষের ছাইয়ের মধ্যে তো কোনো পার্থক্য নেই তবে মানুষগুলোর মধ্যে কেন এত পার্থক্য? মৃত্যর পর তো এই কালো রঙেই সবাইকে ফিরতে হবে। ওরা সবাই তা জানে তবুও ওরা আমায় ঘেন্না করতো। বড্ড ঘেন্না করতো।

One thought on “মৃত্যর পর তো এই কালো রঙেই সবাইকে ফিরতে হবে Heart touching Bangla Story

  • I really like your blog.. very nice colors & theme. Did you create this website yourself or did you hire someone to do it for you? Plz reply as I’m looking to create my own blog and would like to know where u got this from. many thanks

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *